
https://www.varendratimes.com/
5099
rajshahi
রাজশাহীর রাতের আলো ও পরিবেশের ওপর প্রভাব
প্রকাশিত : ০১ জুন ২০২৫ ১৪:১৬
নিশি নামলেই রাজশাহী শহরের বিভিন্ন সড়ক সড়কবাতির ঝকঝকে আলোর ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে ওঠে। রাতের নিরবতার মাঝে এই আলোতে মুগ্ধ হন পথচারী, ভ্রমণপ্রেমী ও প্রকৃতিপ্রেমীরা। এ জন্যই নগর ব্যবস্থাপনাকে ‘আলোর শহর রাজশাহী’ হিসেবে প্রশংসা করা হয়। তবে এই অতিরিক্ত আলোর কারণে উদ্বিগ্ন পরিবেশ কর্মীরা সতর্ক করছেন, কারণ অপরিকল্পিত আলোকসজ্জা রাজশাহীতে ‘আলো দূষণ’ সৃষ্টি করছে।
পরিবেশবিদদের মতে, অতিরিক্ত ও ঊর্ধ্বমুখী কৃত্রিম আলোর কারণে রাজশাহীর রাতের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য ভেঙে পড়ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিশাচর প্রাণী এবং পরিযায়ী পাখিরা সবচেয়ে বেশি। তারা প্রাকৃতিক অন্ধকারের পরিবর্তে কৃত্রিম আলোতে মানিয়ে নিতে না পারায় পথে ভুলছে এবং তাদের জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে পশুপাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তারা।
প্রাণী ও প্রকৃতি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ থেকে জানা যায়, পরিযায়ী পাখিরা রাতে তারা ও চাঁদের আলোকে পথপ্রদর্শক হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু শহরের অতিরিক্ত ও ঊর্ধ্বমুখী আলো তাদের স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন করছে। এর প্রভাব পড়েছে শহরের পাশাপাশি পদ্মা নদীর পাড় ও চরগুলোর পশুপাখির আনাগোনায়। এতে পেঁচা, বাদুড়, পানকৌড়ি, শালিক, সান বার্ড, চখাচোখিসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিপদগ্রস্ত হচ্ছে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে শহরের অধিকাংশ সড়কে আধুনিক ও নান্দনিক LED সড়কবাতি বসানো হয়েছে। যেমন কাশিয়াডাঙ্গা মোড় থেকে বিলশিমলা রেলক্রসিং পর্যন্ত চার দশমিক দুই কিলোমিটার সড়কে ১৭৪টি পোলে মোট ৩৪৮টি LED বাতি স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য এলাকায় মিলিয়ে শতাধিক পোলে নতুন সড়কবাতি বসানো হয়েছে।
তবে সবচেয়ে আলো ঝরাচ্ছে কল্পনা সিনেমা হল মোড় থেকে তালাইমারি, এবং তালাইমারি থেকে ভদ্রা হয়ে রেলগেট ও সাহেববাজার থেকে কোর্ট এলাকা পর্যন্ত সড়কে থাকা ‘রাজমুকুট’ নামে পরিচিত সড়কবাতি গুলো। প্রতিটি পোলের মাথায় ১৩টি ঊর্ধ্বমুখী লাইট লাগানো হয়েছে, যা অতিরিক্ত আলো দিয়ে নিশাচর প্রাণীদের জন্য সমস্যার কারণ হয়েছে। বিদ্যুতের খরচ কমানোর জন্য বর্তমানে একাধিক লাইট পালাক্রমে চালু করা হচ্ছে।
পাখি বিশেষজ্ঞ হাসনাত রনি জানান, গত কয়েক বছরে ঊর্ধ্বমুখী আলোর কারণে রাজশাহীর পাখি ও নিশাচর প্রাণীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। পানকৌড়ি, বক, নিশিবক, পেঁচাসহ নিশাচর পাখিরা এখন দিকভ্রান্ত হয়ে চলাচলে সমস্যায় পড়ছে। পদ্মা নদীর চরগুলোও এখন ফাঁকা হয়ে গেছে বলে তিনি জানান।
ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে রাজশাহী শহরে পেঁচার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তারা প্রাকৃতিক আলোতে চলাচল করে, কিন্তু শহরের কৃত্রিম আলোতে তাদের মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে তাদের প্রজনন হারও কমছে এবং তারা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। শালিক, কাক, টিয়া, চখাচোখি ও সান বার্ডসহ অনেক সাধারণ পাখির সংখ্যা নিয়মিত কমছে।
বিশ্ব পরিব্রাজক তারেক অনু বলেন, হিমালয় থেকে আসা অনেক পরিযায়ী পাখি পদ্মার পার হয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে আসে, কিন্তু ঊর্ধ্বমুখী আলো তাদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করছে। তিনি আরও বলেন, লাইট যদি নিচের দিকে মুখ করে দেয়া হয় এবং ঊর্ধ্বমুখী আলোতে শেড দেওয়া হয়, তাহলে এই সমস্যা অনেকটাই কমানো সম্ভব।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আহমেদ আল মইন পরাগ বলেন, নিশাচর প্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়া সত্যিই একটি উদ্বেগের বিষয়। আলো দূষণও এর কারণ হতে পারে। আলোতে শেডিং বা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব, তবে এ বিষয়ে পরিবেশবাদীদের থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ এলে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলেও জানান।
সার্বিকভাবে, রাজশাহীর অতিরিক্ত এবং অনিয়ন্ত্রিত আলোর কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নিশাচর প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আলো দূষণ কমাতে যথাযথ পরিকল্পনা ও সচেতনতার মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবেলা জরুরি।