https://www.varendratimes.com/

1522

special-report

রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখা ভয়াল সে রাত্রির

প্রকাশিত : ১৫ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৪২

২০০৭ সালে ১৫ নভেম্বর। বৃহস্পতিবার। এ দিন ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশেকে তথা দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। কেড়ে নিয়েছিল হাজার হাজার মানুষের তাজা তাজা প্রাণ। একদিকে দেশে চলছিল ঘোমট শাসন অন্যদিকে প্রকৃতির প্রলয়। এক কথায় ভয়াল-ভীতিকর। 

 

সিডরের আঘাতে যে অঞ্চলগুলোর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল সেই অঞ্চলসমূহের একটি মঠবাড়ীয়া উপজেলার বলেশ্বর নদীর তীরবর্তী উলুবাড়ীয়া গ্রামে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। সিডরের রাত্রিতেও ভাগ্যক্রমে গ্রামে ছিলাম! কোন একটা উপলক্ষে আমাদের বাড়ীতে ভাই-বোনসহ পরিবারের সকল সদস্যরা উপস্থিত ছিল।

অতীতে বন্যার কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় তেমন ভয়ানক কিছুই আঁচ করতে পারছিলাম না বরং এক ধরনের রোমাঞ্চকর উত্তেজনায় ভূগছিলাম। পরিবারের জেষ্ঠ্যদের মধ্যে চিন্তার স্পষ্ট রেখা ফুটে উঠলেও আমার তেমন কোন ভাবান্তর হয়নি। সে রাতে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাকর ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল এবং আমি শুয়ে শুয়ে তা দেখছিলাম।

হঠাৎ টেলিভিশনের স্ক্রুলে শিরোনামে ভেসে উঠলো, দু’ঘন্টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সিডর বলেশ্বর নদী দিয়ে অতিক্রান্ত হবে। এ সংবাদ দেখার পরেও ব্যক্তিগতভাবে মনোভাবের পরিবর্তন হয়নি বরং আমি খেলাতেই ছিলাম।

বাবাকে খুব বিষন্ন দেখছিলাম এবং তিনি কিছু সময় পরপর টেলিভিশন এবং রেডিওতে খবর শোনার চেষ্টা করছিলেন এবং যতক্ষন মোবাইলে নেটওয়ার্ক ছিল ততক্ষন বিভিন্ন যায়গায় মোবাইল করে সেখানের অবস্থা জানছিলেন।

বলেশ্বর নদী থেকে সিডর অতিক্রম করার সংবাদ দেখে তিনি কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লেন কারন তার ১৯৭০ এর ১২ নভেম্বরের সেই ভয়াল গোর্কির রাত্রের অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। উল্লেখ্য যে, আমাদের বাড়িটি তখনো টিনশেটের ছিল এবং অনেকদিনের পুরানো। বাবা ভরসা পেলেন না। তার মনে কোন এক অজানা আতঙ্ক যা স্পষ্টই তার চেহারায় ফুটে উঠেছিল। আমাকে নির্দেশ দিলেন, পরিবারের সকলকে পাশের গ্রামে ছোট বোনের পাকা বাড়ীতে রেখে আসার জন্য। সবাই বোনের বাড়ীতে যেতে রাজী হলেও মা অনড়। তিনি বাবা এবং ঘর ছেড়ে কোথাও যাবেন না। তখন বাহিরে তুমুল বাতাস বইছিল।

ছোট ছোট ভাইপো-ভাগনীদের কোলে নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রওয়ানা দিলাম এবং মিনিট বিশেকের সংগ্রামের পরে তাদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিতেও সক্ষম হলাম। যাওয়ার পথে রাস্তায় কেবল দু’একটি গাছ পড়ে থাকতে দেখেছিলাম কিন্তু তাতে যাত্রাপথে খুব বেশি সমস্যার সৃষ্টি করেনি। বিপত্তিটা বাঁধল আমার ফেরার পথে।

সকলের নিষেধ উপেক্ষা করে প্রবল বাতাসকে পাশ কাটিয়ে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসার জন্য এক প্রকার জেদ চেপেছিল।

 

হাতে পাঁচ বেটারির চার্জার লাইট এবং সৃষ্টিকর্তা সৃষ্ট বিজলীর চমক তো আছেই। অনেক সাহস করে রাওয়ানা দিয়েছিলাম। কিছু পথ পেরিয়ে বড় রাস্তায় ওঠার পর বুঝলাম ফেরার সিদ্ধান্তে ভুল ছিল কেননা রাস্তায় গাছ পড়ে আটকে আছে। পিছনে আর ফিরতে ইচ্ছা করল না। বাতাসের বিপরীতে প্রাণপনে ছুটছি কিন্তু পথ এগুচ্ছে না। একদিকে বাজ এবং গাছ পড়ার শব্দ অন্যদিকে প্রবল বাতাস। ভয়ে গোটা দেহে শিহরণ খেলছিল। গাছের বাঁধ পেরিয়ে ফাঁকা পেলেই ছুট কিন্তু সে ছোটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে না। কারন রাস্তজুড়ে পতিত গাছে সারি। মিনিট চল্লিশের চেষ্টায় প্রায় মাঝ পথ পাড় হয়ে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার সামনের রাস্তার পাশে শতাব্দী প্রাচীন বিশাল এক তেঁতুল গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম। অনেকটা ক্লান্ত এবং বাতাসের তীব্রতায় সকল শক্তি প্রয়োগ করেও আর সামনে এগোতে পারছিলাম না। সম্ভবত মিনিট পাঁচেক তেঁতুল তলায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই পাঁচ মিনিটের অভিজ্ঞতার স্মৃতি মৃত্যুর পূর্বে মিইয়ে দেয়া যাবে না। মনে হচ্ছিল-এখনি বোধহয় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার মধ্যে ভয় ঢুকে গিয়েছিল এবং ভাবছিলাম এটাই মনে হয় জীবনের সর্বশেষ মূহুর্ত। বাবা-মায়ের কাছে ফিরতে পারব তা একবারের জন্যও মনে হয়নি। বাবা-মায়ের কোলে ফিরবার জন্য শেষ চেষ্টা করতে লাগলাম। তেঁতুল তলা ছেড়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে ছুটলাম। তেঁতুল গাছটা ছেড়ে বিশ সেকেন্ডর পথ এগুনোর পরে চর-চর করে বিকট শব্দ শুনলাম। সম্মূখে গতি রেখেই পিছন ফিরে লাইটের আলো রেখে দেখলাম, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম শতবর্ষী তেঁতুল গাছটা সে দিকেই উপুড় হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছিল জ্ঞান হারাচ্ছি কিন্তু শেষ অবধি মনের জোড়ে শরীরে অনেক ক্ষত চিহ্ন নিয়ে বাড়ীতে পৌঁছলাম। বাড়ীতে পৌঁছার পর বাতাসের গতি আরও বেড়ে গেল। মনে হচ্ছিল, সবকিছুকে ধ্বংসাবশেষে পরিণত করে যাবে। কিছুই অবশিষ্ট রাখবে না। বাতাসের তীব্র বেগে বাড়ীর অসংখ্য নারিকেল-সুপারিগাছসহ সবকিছু ভেঙ্গে কিংবা উপড়ে যাচ্ছিল । সে দিকে আমার কোন খেয়াল নেই যেন চেতনাশূণ্য হয়ে রয়েছি। রাস্তার তিক্ত অভিজ্ঞতা, তেঁতুল গাছটি উপরে পড়ার দৃশ্য এবং তেঁতুল তলায় আমার দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থান কেবল স্মৃতিপটে ভাসছিল। 

 

সিডরে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছিল রায়েন্দা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়ন। শুধু বেড়িবাঁধের অভাবে পানিতে প্লাবিত হয়ে হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছিল সিডরের চারদিন পর, গ্রামের কয়েকজন বন্ধু মিলে সাউথখালীর অবস্থা দেখতে গিয়েছিলাম। পরিচিত এক বাড়ীতে গেলে, সে বাড়ীর এক বয়স্কা মহিলা আমাদেরকে তাদের বাগান-বাড়ির ধ্বংসস্তুপ ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল আর হাপিত্যেশ করছিল।

হঠাৎ চোখে পড়ল এক মহিলার মরদেহ। সিডরের চারদিন অতিবাহিত হলেও কেউ জানে না কোথা থেকে সে ভেসে এসেছে। যে ডোবাটিতে মহিলার মরদেহ ভাসছিল তার পাশেই সুন্দর একটি পুতুলের মত কিছু একটা ভাসছিল। খুব কাছে গিয়ে দেখলাম, পুতুল নয় বরং সদ্য জন্ম নেয়া একটি ফুটফুটে বাচ্চার নিথর দেহ। আমরা নিজেদেরকে আর স্থির রাখতে পারছিলাম না।

সাথে থাকা বৃদ্ধা জানাল, গত বিকালেও শুধু মহিলার লাশ ছিল। তখন বুঝলাম, রাতের কোন এক সময়ে এ বাচ্চাটি পৃথিবীতে এসেছে।

আজও চোখ বুজলে সে বাচ্চাটির ছবি ভেসে ওঠে। শুনেছি, স্রষ্টা ধরাবাসীর পাপের শাস্তি দেয়ার জন্য মাঝে মাঝে বিপদ দিয়ে শাস্তি দিয়ে থাকেন। কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না, সদ্য জন্ম নেয়া পুতুলের চেয়েও সুন্দর বাচ্চাটির দোষ কোথায়? ওই দিন বন্ধুরা মিলে অনেক পথ হেঁটে ছিলাম আর মানুষের করুন অবস্থার স্বাক্ষী হয়েছিলাম। আজও আঁৎকে উঠি যখন ১৫ নভেম্বর এবং তৎপরবর্তী দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করি।