
https://www.varendratimes.com/
1540
special-report
প্রকাশিত : ১৫ নভেম্বর ২০২৪ ২১:৫১
প্রাচীন মিশরে সুদি মহাজনরা আদায়ের জন্য আঙিনায় যেভাবে লম্বা লম্বা বেঞ্চিতে হিসাবের খাতা-কলম নিয়ে বসতো অনুরূপ আসনবিন্যাস এখন বাংলাদেশের বিয়েবাড়িতেও দেখা যায়। বর-কণের বাড়িতে কিংবা কমিউনিটি সেন্টারের গেটে আমন্ত্রিত অতিথিদের কাছ থেকে উপহার আদায়ের জন্য খাতা-কলম নিয়ে কোন একপক্ষ হাসিমুখে বসে থাকে। যার উপহার যত ভারি হয়, যার খাম যত পুরু হয় তার দিকে আদায়কারীর হাসি তত চওড়া হয়। দু'একজন যারা উপহার না নিয়ে আসে কিংবা ফ্রিতে খেয়ে যায় তাদের দিকে আদায়কারীদের দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্য থাকে! ভাবসাবে বুঝিয়ে দেয়, এটা কোন ফকির-মিসকিনের আসর নয়। নিমন্ত্রণ মানেই মাগনাতে গলাধঃকরণ নয়; দাও অতঃপর খাও।
আজকাল বিয়েতে আমন্ত্রণ একধরণের আতঙ্কের সৃষ্টিকারী। খেতে যেতে হবে অথচ উপহার দেওয়া হবে না- তা হবে না, তা হবে না। এখানে এখন মাগনা খাওয়ার প্রচলন নাই। খামের মধ্যে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে উর্ধাঙ্কে যে যা দিতে পারে। তবে চালাক মেহমান খামের মধ্যে ১০০ টাকার পাঁচখানা পুরাতন নোট ডুকিয়ে খাম একটু মোটা বানায়। আদায়কারী যদি চালাক হয় তবে সে খাম খুলে গুণে গুণে খাতায় নামসহ লিপিবদ্ধ করে। আবার উপহারদাতার নাম ও উপহারের ধরণ-অঙ্ক আশেপাশের সবাইকে জোরে জোরে শুনিয়ে বলে। কেউ কিছু না দিয়ে নিমন্ত্রণ খেয়ে গেলে গৃহস্থ সেসব হিসাব রাখে এবং সুযোগ বুঝে খোঁটা দেয়। কেউ কেউ প্রতিশোধস্বরূপ পাল্টা নিমন্ত্রণে ফ্রিতে খেয়ে আসে। সমাজের এই যে প্রচলন এটা মানুষে মানুষে আন্তরিকতা নষ্ট করেছে। ধনী আত্মীয়স্বজনে বাড়িতে গরীবের নিমন্ত্রণ ও যাতায়াত চিরতরে বন্ধ করেছে। উপহার সংস্কৃতির নামে অসুস্থ সামাজিকতার এই প্রচলন দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে!
শুধু কি বিবাহ? জন্মদিন, সুন্নাতে খাৎনা, বিবাহ বার্ষিক কিংবা আকিকা মোটকথা শ্রাদ্ধ ছাড়া সবগুলো আয়োজন-আমন্ত্রণ মানেই উপহার প্রাপ্তির উপলক্ষ্য সৃষ্টি করে। নিমন্ত্রণদাতা যদি বস হয়, সিনিয়র হয় কিংবা সমাজের প্রভাব-প্রতাপশালী হয় তবে আমন্ত্রিতরা মহাযন্ত্রণায় পতিত হয়। ওপরওয়ালারা যদি অসন্তুষ্ট হয় তখন কপালে বিপত্তি থাকে। সেজন্য সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও দাওয়াতদাতার সন্তুষ্টির জন্য গিফট দিতে হয়। কবি আহসান হাবিবের বিখ্যাত 'ধন্যবাদ' কবিতার সেই আমন্ত্রিত কেরানী জন্মোৎসবের কেন্দ্র তথা ডলির জন্য চকলেট আনলেও ডলি(কুকুরছানা) সেটা নেয় না- এমন ভাগ্য তো এই জমানায় অতিথিদের হয় না! বরং কে কী উপহার এনেছে, তার ওপর ভিত্তি করেই খাওয়া ও খাতির বরাদ্ধ হয়। অনুষ্ঠান শেষে উপহার ও উপহার দাতাদের নাম ও রুচি নিয়ে পারিবারিক বিতর্ক সভার আয়োজন করা হয়।
বিবাহ কিংবা যে কোন আয়োজনে স্বেচ্ছায় বাধ্যতামূলক করে উপহার গ্রহণ, উপহার প্রদানে সামাজিক চাপ তৈরি করা- এসব জঘন্য পর্যায়ের ছোটলোকি কারবার। অথচ সমাজের বড়লোক-বিত্তবানরা এই ছোটলোকি দরবার বারবার, বছরে বহুবার আয়োজন করে। কখনো কখনো কোন কোন আয়োজনে কেউ কেউ কার্ডে লিখে দেয়- উপহার গ্রহনযোগ্য নয় অথবা মুখে বলে দেয়- অনুগ্রহপূর্বক কিছু আনবেন না। এমন বড়মনের প্রশংসা করতে হয় যদিও এ সংখ্যা যৎসামান্যই। অথচ বাঙালি এসব শুনে মনেপ্রাণে আরও বেশি সংশয়ে পড়ে- আমি গরীব বলেই কি আমাকে উপহার নিতে নিষেধ করেছে? তখন সে আগে যা দিতে মনস্তাপে ছিল তার কয়েকগুণ বেশি দামে উপহার কেনে নিয়ে যায়! সমাজে সৌহার্দ্যপূর্ণ আন্তরিকতার যে সিস্টেম সেটা মোটামুটিভাবে আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। এখন হোটেলের মত দাওয়াতে খেতেও টাকা দিতে হয়! পার্থক্য শুধু- হোটেল খেয়ে তারপর বিল পরিশোধ করতে হয় আর নিমন্ত্রণে আগে বিল পরিশোধ করে তারপর খেতে হয়!
উপহার ভীতি মানুষকে অসামাজিক হতে বাধ্য করছে। প্রত্যেক মাসে যদি দু'চারটা নিমন্ত্রণ থাকে এবং নিমন্ত্রণ মানেই সেখানে উপহার দিতে হয় তবে মানুষকে অবৈধভাবে টাকা রোজকার করতেই হবে। যারা কুলোতে পারে না তারা পিছুটান দেয়, পালিয়ে বেড়ায়। আত্মীয়প্রীতি শিকেয় ওঠে। কখনো কখনো দাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও উপঢৌকন পাঠিয়ে দিতে হয়! এটা সামাজিকতা নাকি অসামাজিকতার সর্বোচ্চ- সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে! তবে সমাজে থাকলে সমাজের সাথে মিলেমিশে থাকতে হয়। এজন্য অনিচ্ছাতেও অনেকেই ঢেঁকি গিলতে বাধ্য হয়।
যে সমাজের সু-রীতি নষ্ট করে ফেলেছি, ভ্রষ্টতার পথে হাঁটছে সংস্কৃতি সেখানে দু'চারজনের বিদ্রোহী হওয়া প্রয়োজন। কোন ধরণের উপহার নেবো না কিংবা দেবো না- প্রবল আত্মবল ও বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে তবেই কেবল কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে এবং অন্যের আয়োজনে অংশগ্রহণ করতে হবে। ডেকে খাওয়ায়ে বিনিময় রেখে দিলে সেটাকে সুস্থতা বলা যায় না। এখানে মানবিকতাবোধ প্রচন্ডভাবে অনুপস্থিত। কতটাকা খরচ হবে আর কত টাকা উসুল হবে- এমন হিসাবনিকাশের মাশুল এই সমাজ সুদাসলে দিচ্ছে। সামাজিক বন্ধন, আন্তরিকতা কিংবা আত্মীয়তার টান- এই সমাজে চরমভাবে অনুপস্থিত। যে সমাজে বসবাস করতে হবে, সেই সমাজের নীতিপদ্ধতি নিয়ে আমাদেরকেই ভাবতে হবে। উপহার, সামাজিকতা এবং মনোভাবে বদল ঘটাতে হবে। যে অসুস্থতা চলছে তা কাউকে না কাউকে উদ্যোগী হয়ে থামাতে হবে- সেটা আপনি/আমি হতে পারি না?