
https://www.varendratimes.com/
5014
rajshahi
প্রকাশিত : ২৪ মে ২০২৫ ১৩:০৯
বাংলাদেশে প্রতিবছরই বাড়ছে আমের বাগানের পরিধি এবং উৎপাদনের মাত্রা। দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সম্প্রতি আম রপ্তানির দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। রাজশাহী অঞ্চলের চারটি জেলায় গত দুই দশকে আমবাগানের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। উন্নত জাতের আম চাষ, উর্বর মাটি ও অনুকূল জলবায়ুর প্রভাবে এই অঞ্চল আম চাষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আম এখন একটি লাভজনক বাণিজ্যিক কৃষিপণ্যে রূপ নিয়েছে, যা কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. আজিজুর রহমান জানান, বছরের বিভিন্ন সময়ে আমভিত্তিক কাজ চললেও মে থেকে আগস্ট—এই চার মাস রাজশাহীর গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হয়ে ওঠে। চলতি মৌসুমে রাজশাহীসহ চার জেলায় ১২.৫৫ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। গাছ থেকে আম নামানো, পরিবহন, প্যাকেজিং, মজুতকরণসহ নানা কাজে তিন লাখের বেশি মানুষের মৌসুমি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এ বছর অনুকূল আবহাওয়ার ফলে আমের সম্ভাব্য উৎপাদন ২৮ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছাতে পারে। যদিও দেশের বিভিন্ন স্থানে আম চাষ বাড়ছে, তবে রাজশাহী অঞ্চল এখনো শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। দেশের মোট আমের প্রায় অর্ধেকই উৎপাদিত হয় রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে—৪.৫৮ লাখ মেট্রিক টন। এখানে উৎপন্ন ফজলি আম দেশব্যাপী জনপ্রিয়।
নওগাঁ, রাজশাহী ও নাটোরেও যথাক্রমে ৩.৭৮, ২.৮৫ ও ১.৩৪ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবীব বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এখন ৯৭ জন বাণিজ্যিক আমচাষি রয়েছেন এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনার ফলে আমের গুণগতমান ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাজশাহীতে দেশীয় জাতের গুটি ও গোপালভোগ জাতের আম বাজারে উঠতে শুরু করেছে। জেলার আম আগে পাকায় বাজারে আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর এবং নওগাঁর আম পরবর্তীতে আসে। কানসাট, বানেশ্বর, বাঘা, আড়ানী ও লালপুরের মোকামগুলোতে আম কেনাবেচা পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। এসব মোকামে আমচাষি, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, চালানি, পরিবহনকর্মী ও ঝুড়ি প্রস্তুতকারীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
চালানি ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম জানান, মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই অঞ্চলে আমের বাণিজ্য খুবই চাঙা থাকে। গুটি ও লক্ষণা আমের পর ধাপে ধাপে আসবে ক্ষীরসাপাতি, ন্যাংড়া, ফজলি, বারি-৪, গৌড়মতি, আম্রপালি ও আশ্বিনা জাত। আমকে ঘিরে এই অঞ্চলের পরিবহন, হোটেল, ব্যাংক, কুরিয়ার, ঝুড়ি নির্মাণসহ নানা খাতে ব্যাপক ব্যবসায়িক কার্যক্রম দেখা যায়।
বানেশ্বরের আম ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হোসেন বলেন, আম হলো ‘টাকার ফল’। এক মৌসুমে একজন শ্রমিক থেকে শুরু করে ভ্যানচালক পর্যন্ত কয়েক মাসের আয় দিয়ে ছয় মাসের খরচ চালাতে পারেন। অনেকে অনলাইনে আম বিক্রি করেও লাভবান হচ্ছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ ও নাটোরের বিভিন্ন মোকামে বড় বড় আড়ত গড়ে উঠেছে। আবু সাঈদ নামের এক চালানি জানান, তিনি প্রতি মৌসুমে লাখ লাখ টাকার কমিশন ব্যবসা করেন এবং ২০ জন শ্রমিক তার আড়তে কাজ করে।
নওগাঁ জেলার সাপাহার ও পোরশা এলাকায় আম্রপালি আমের চাষ ব্যাপক হারে হচ্ছে। সাপাহার এখন আম বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, প্রতিদিন এখান থেকে প্রায় ৩০০ ট্রাক আম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়। এখানকার ব্যাংকগুলোতে লেনদেনের চাপ বেড়ে যায় আমের মৌসুমে। স্থানীয় ব্যাংক কর্মকর্তা সাবিরুল ইসলাম জানান, জুনের মাঝামাঝি থেকে লেনদেন অনেক বেড়ে যায় এবং তারা আগেভাগেই প্রস্তুতি নেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ড. ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ধান ও আলুর পর এখন কৃষি অর্থনীতিতে আমের ভূমিকা ক্রমেই বাড়ছে। সরকার ও উদ্যোক্তারা উদ্যোগ নিলে আমভিত্তিক কৃষি ও শিল্পবিন্যাস সারা বছর ধরে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। তবে উৎপাদনের তুলনায় রপ্তানি এখনো সীমিত পর্যায়ে রয়ে গেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের “রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প”-এর পরিচালক আরিফুর রহমান জানান, রপ্তানির উপযোগী আম উৎপাদনে কৃষকদের সহায়তা প্রদানই এই প্রকল্পের লক্ষ্য। প্রতিবছর কিছু আম বিদেশে পাঠানো হচ্ছে, এতে আমের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্ভাবনা বাড়ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমবাগান পরিদর্শন শেষে বলেন, রপ্তানির জন্য মানসম্মত আম উৎপাদন এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। বিদেশে আম পাঠাতে হলে নির্ধারিত মান ও শর্ত মানতে হয়। সরকার চাষিদের প্রণোদনা দিচ্ছে এবং এ বছরও কিছু আম রপ্তানি হবে, যদিও পরিমাণ নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়।